নিজের জীবনযাত্রা আর অথনৈতিক লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম আমি। স্কুল জীবনে অন্য সকলের মাঝে আমাকে যাতে স্বাভাবিক লাগে সে জন্য অনেক অভিনয় ও পরিশ্রম করতে হতো। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি কি ধরণের মানসিক পরিশ্রম ও শারীরিক অভিনয় করতাম। সে যুগে স্কুলে প্রায় সকলেই বেশ দামী পেন্সিল বক্স, টিফিন বক্স, জলের বোতল আর ব্যাগ নিয়ে যেত। আমার ক্ষেত্রে অতি নিম্নমানের এবং অনেক জুলুম করে কেনা প্লাস্টিকের পেন্সিল বক্স, মধ্যবিত্তের ছাপ লাগানো স্টিলের টিফিন বক্স, কোলড্রিঙ্কসের বোতলের জলের বোতল আর পাড়াতুতো কাকাকে দিয়ে তৈরি করা সস্তার স্কুল ব্যাগ।
বাড়িতে ভালো উন্নতমানের এই সব সামগ্রীর ডিমান্ড করলে মাঝে মাঝে উপদেশ ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। এই ধরুন, আমার পূর্বপুরুষরা দড়ি লাগানো ডোরাকাটা পেন্টালুন পরে কলেজে যেত, স্কুলে খালি পায়ে যেত, ইত্যাদি ইত্যাদি। একবার তো নতুন জলের বোতল কিনে দিতে বলতে বলেছিল, গাড়ির মোবিলের কৌটো ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে তো জল নিয়ে যেতে পারিস।
যাই হোক, বেশী না হেজিয়ে আসল ঘটনায় আসছি। অন্যসব সহপাঠীদের সাথে তাল মেলাতে আমাকে মাঝে মধ্যে ছোটখাটো মিথ্যা বা অর্ধসত্যের আশ্রয় নিতে হতো। ওই টুকু না করলে যেন ওই সমাজে আমি বেমানান মনে হতো। আমাদের বাড়িতে একটি বহু পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ার আর বেশ কিছু ক্যাসেট ছিলো। জন্মের পর থেকেই এদের সাথে আমার বেশ মাখামাখি ছিলো। যখন গ্রাম থেকে বারাসাতে এলাম, সঙ্গে এটিও এসেছিলো। বাবা কাকার কেনা বহু পুরনো সিনেমার গানের ক্যাসেট, তবে এই মধ্যে বেশ কিছু মহম্মাদ রফি সাহেবের ক্যাসেট ছিলো। স্কুলে একদিন গান বাজনার কথা উঠেছিলো, আমিও অংশগ্রহণ করলাম এই আলোচনায়। যে যার মতো তাদের কথা বললো, বাড়িতে কি ক্যাসেট আছে, তাদের প্লেয়ার কোন কোম্পানির ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভাব বুঝে আমিও কিছু অর্ধসত্যের বোমা মেরে দিলাম। বললাম, ” আমাদের বাড়িতে মোহাম্মাদ রফি সাহেবের HMV এর ফুল সেট Anmol Ratan আছে”। আমার এই কথা হয়তো কেউ কানেই নেয়নি, তবে এটা বলতে পেরে সে সময় নিজে নিজেই গর্ব অনুভব করেছিলাম। মহাদের এই কথাটা শুনেছিলো এবং মনেও রেখেছিলো। মহাদেব প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসবে বলতো, এদিকে আমি নানা অজুহাতে বাধা দিতাম। ওরা বারাসাতের পুলিস কোয়াটারে থাকতো, ওর বাবা পুলিশ ছিলেন। এদিকে আমাদের বাড়ির তো দৈন্যদশা। প্লাস্টারহীন তিন কামরা ঘর, ফুটো যুক্ত টিনের দরোজাওয়ালা বাথরুম, আম কাঠের নড়বড়ে চৌকি, শুকিয়ে বেকে যাওয়া নিম্নমানের কাঠের দরোজা জানলা আরও কত কি। যাই হোক আমার অনিচ্ছা থাকা সর্তেও ওরা এলো আমাদের বাড়িতে। মহাদেব, মহাদেবের মা আর দিদি।
বেশ কয়েক ঘটা ছিলো ওরা। বাড়ির সকলের সাথে আড্ডা গল্প চললো সকলের। এদিকে শুধু আমি কেমন অপ্রস্তুত ও হীনমন্যতায় ভুগছি। আগে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম যে এক হাট লোকের মাঝে আমার প্যান্ট খুলে গিয়েছে আর সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বার করে হাসছে। সে এক আজব অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠতাম। মহাদেরা আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকে ঠিক সেই অনুভূতি হচ্ছিলো। শেষমেশ আমাদের বড় ঘর অর্থাৎ ড্রইং রুম অর্থাৎ বৈঠকখানাতে এসে আমার ক্যাসেটের সংগ্রহ দেখছিলো। আমি ওর পিছু পিছু। দেখতে দেখতে হঠাৎ ও প্রশ্ন করলো –
“মোহাম্মাদ রফির সেটটা কই?”
আমার তো এ প্রশ্ন শুনে গলা শুকিয়ে কান গরম হয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলবো ভাবছি। ও কিন্তু ক্যাসেট দেখে চলেছে। আবার আমাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। কোন রকমে ঢোক গিলে বললাম,
“ও সেটটা গ্রামের বাড়িতে আছে”
মহাদেব আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো। সেই বয়সে সে আমাদের দুর্দশা বুঝতে পেরেছিল। মুখে বা হাবভাবে প্রকাশ করেনি। তবে ওর ওই মুচকি হাসির অর্থ সে সময় বুঝেছিলাম। অবশেষে অপরাধীকে ধরতে পারার পরে পুলিশের ঠোঁটের কোনে যে হাসি থাকে, সেটা ছিলো সেই হাসি। আজ মহাদেব প্রতিষ্ঠিত একজন পুলিশ অফিসার, আর আমি এখনো হীনমন্যতায় ভুগি আর মাঝে মাঝে ব্লগ লিখি।